রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই

 


চোখ ভর্তি জল, রুম বন্ধি আমি!! অন্যদিকে, প্রতিটি নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনে মেইন শিরোনাম," ইয়ং জেনারেশনের আইডল, এমপি আব্রাহাম ফারহাদ সমুদ্র শেখ শহরের নামকরা রেস্টুরেন্টে নিজের কনট্রোল হারিয়ে ভাঙচুর করেছে। তার সঙ্গে এক সুন্দরী রমণীকে ও দেখা গেছে।" 


চোখের জল থামছেই না, অথচ এইখানে আমার বিন্দুমাত্র ও দোষ নেই। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি সপ্তাহ হলো, আমরা তিন বান্ধবীরা মিলে ঠিক করেছিলাম রিইউনিয়ন করব, ঘুরবো আর একটু আনন্দ করবো...তাই তো আজ বিকেলবেলা, প্লান মতো একটি রেস্টুরেন্টে যাই। 


সবকিছু ঠিকঠাক ই ছিল, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা দশ অথবা বারো বছরের ছোট্ট ছেলে দৌড়ে এলো আমার কাছে, এসেই হাতে তিন চারটে কিটক্যাট চকলেট, কয়েকটি‌ ফুলসহ একটি চিরকুট হাতে দিয়ে বলল, একটা ভাইয়া এগুলো তোমাকে দিতে বলেছে। আর কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই, ছেলেটি দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বাহিরে বের হয়ে গেল। 


ঘটনাটি এতোই দ্রুত ঘটেছে আমি কিছু করব অথবা বলব তার সময় টুকু ও পাই নাই। হাতে দেওয়া ফুলগুলো, চকলেট গুলো টেবিলে রেখে চিরকুট টা খুলব তার আগেই কেউ ঝড়ের গতিতে আমার হাত থেকে চিরকুট টা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। 


পিছনে তাকাতেই, চোখ বড় বড় হয়ে গেল, একটা ঢুক গিললাম, সাথে সাথেই মনই মন বলে উঠল....মোবাইল ফোনের যুগে চিরকুট পেয়ে যতোটা না সারপ্রাইজ হয়েছি, তার চেয়েও বেশি সারপ্রাইজ হয়েছি আমার পাওয়া সদ্য চিরকুট টা এমপি আব্রাহাম ফারহাদ সমুদ্রের হাতে দেখে। ভয়ে কলিজা থরথর করে কাঁপছে আমার। এই সময়ে ওনি এখানে কি করছে, আল্লাহ রে... এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। এই ব্যাটার সামনে আমি পড়তে চাই না। আমার বান্ধবী গুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতেছে। 


আমি আয়াতুল ফারিন ঝিনুক। যাকে দেখে কলিজা কাঁপতেছে সে আমার চাচাতো ভাই আব্রাহাম ফারহাদ সমুদ্র শেখ। সদ্য পাসকৃত সর্বোচ্চ ভোটের এমপি। ওনি নাকি ইয়ং আইডল, কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে বড় টর্নেডো ঝড়। যাকে দেখলে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে। যাই হোক এ কথাটি কেন বলতেছি, একটু পরেই বুঝতে পারবেন। 


সমুদ্র ভাইয়া চিরকুট টা খুলল, খুলে একনজর দেখলো, তারপর আমার দিকে লাল টকটকা চোখ নিয়ে তাকালো, আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই আমার মন ও মস্তিষ্কে একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল....


....চোখ লাল কিসে...

পিরিতের বিষে নাকি অন্তরের দোষে।

সুযোগ পাইয়া সমুদ্র ভাইয়া 

মারবো পিষে পিষে,

চোখ লাল কিসে

পিরিতের বিষে নাকি অন্তরের দোষে...


সমুদ্র ভাইয়া চিরকুট টা হাত দিয়ে পিষে, রাগে রেস্টুরেন্টের কাঁচের টেবিলে জোরে একটা ঘুষি দিল, সাথে সাথে ই ঝনঝন করে কাঁচের টেবিলটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার হাতে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগলো, কিন্তু তাও ওনার রাগ কমলো না, ওনি সামনে থাকা চেয়ারগুলো কে ও লাথি মারলো, সেগুলো একটু দূরে গিয়ে পড়লো। বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটা মূহুর্তে ই রেস্টুরেন্টের একাংশ লন্ডভন্ড করে চলেছে। 

রেস্টুরেন্টে থাকা বাকি মানুষের শোরগোল পড়ে গেল। ম্যানেজার ও কিছু স্টাফরা দৌড়ে এলো, কিন্তু তারা কাছে এগোনোর সাহস আর পেল না। আমি যে কিছু বলব, না হয় তাকে থামাবো তা আর হলো না। কারন এদিকে তাকে এই অগ্নি রুপে দেখে....আমার শরীর ও নড়ে না, আমার গলা দিয়ে আওয়াজ ও বের হয় না। 

পরক্ষনেই সমুদ্র ভাইয়া হাত ধরে সবার সামনে টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। হাতটা এতো জোরে ধরেছে, আমাকে ছাড়লেই যেন আমি পালিয়ে যাব। অথচ এই হাতেই রক্ত চুপসে পড়ছে....

গাড়িতে চুপচাপ ই ছিলাম। আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছি তার হাতের দিকে, কিন্তু কিছুতেই সাহস হচ্ছে না বলার, সমুদ্র ভাইয়া আপনার হাতের রক্ত বন্ধ করেন, গাড়িতে ফাস্ট এইড আছে। মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে ই গাড়ি বাড়িতে এসে থামলো। ওনি গাড়ি থেকে নেমে আবারো আমার হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।  এখনো হালকা রক্ত চুপসে পড়ছে....


সন্ধ্যা বেলা সবাই ই বাড়িতে, ড্রইং রুমে এনে হাত ছেড়ে দিল। টিভি যে নিউজ দেখতেছিল বড় চাচা, খবরটি এতো তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে, বাড়িতে খবরটি দেখে পরিবারের সদস্যরা আগে থেকেই একত্র হয়েছে। সমুদ্র ভাইয়ার সাদা শার্টটা ও রক্তে লাল হয়ে গেছে, আমার হাতটা ও, মা চাচিরা দেখে চিৎকার করে উঠল, দৌড়ে সমুদ্র ভাইয়ার কাছে এলো, ছোট চাচু দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স এনে সমুদ্র ভাইয়া কে ফাস্ট এইড করে দিলো। 


আমার মা আমার দিকে এগিয়ে এলো, বলল- আয়াত, তুই তো সমুদ্রের সাথে ই এলি, তুই কি এগুলো দেখিস নাই, তোর কি উচিত ছিল না সমুদ্র কে ফাস্ট এইড করে দেওয়া। গাড়ি করেই তো এসেছিস, গাড়িতে ই তো ছিল তাহলে... তাছাড়া এরকম কি করে হলো? 


সবার মনোযোগ কেন্দ্র এখন আমি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি আশেপাশের নীরব থমথমে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করতেছি। চার বছর আগের কাহিনী যেন আবার ও পুনরায় ঘটেছে, কিন্তু কাহিনী ভিন্ন। 


হঠাৎ করেই সমুদ্র ভাইয়া বলল- মামনি (আমার মা), ঝিনুক কে জিজ্ঞেসা করো চিরকুটের ছেলেটি কে? কতদিনের পরিচয়!! তোমার মেয়ে কি ভুলে গেছে, সে আগে থেকেই বিবাহিত।


আমার ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো, সমুদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম - ঐ বিয়ে আমি মানি না। আর আপনি, আবার ও আমার জীবনের উপর অধিকার খাটাচ্ছেন ? এই বাড়িতে আমি আসলেই আপনি....(কিছু বলার আগেই মা ঠাস করে থাপ্পড় মারলো, আমি মায়ের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছি) 


মা - সমুদ্র কি বলতেছে এগুলো তা বল। এই বাড়িতে আজ সকালে আসতে না আসতেই বিকেলে আবার ও একই ডাক আর কাহিনী শুরু করছিস, তোকে...(মারার জন্য হাতটা বাড়াতেই বড় চাচি ধরল, মাকে থামালো)


মনে আবার ও আরেক দফা ঘৃনা জমলো সমুদ্র ভাইয়ার দিকে। বললাম - তোমরা হয়তো সমুদ্র ভাইয়া কে তোমাদের সবকিছু মানতে পারো, কিন্তু আমি তাকে ঘৃণা করি, আমি খুব বেশি ই ঘৃনা করি। সে খুনি, আমার চোখে খুনিই থাকবে। থাকবো না এ বাড়িতে, যে বাড়ি ছেড়েছি চার বছর আগে, এখন ছাড়লে ও ক্ষতি কি, আর কখনো ই আসব না.....


...বলেই এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে.....দরজার দিকে পা বাড়াতেই আচমকা কারো হেঁচকা টানে আমি কারো বুক বাহুদ্বয়ের  উপর পড়লাম.... মাথা উঁচু করে সমুদ্র ভাইয়া কে দেখলাম,সে ঠোঁটে বাঁকা হাঁসি দিয়ে , একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল - একবারের ভুলের মাশুল চার বছর ধরে গুনেছি, এবার ভুল আমার হোক আর তোমার, মাশুল তোমাকে ই গুনতে হবে চড়ুই_বউ, তাছাড়া এবার চড়ুই পাখি তোমাকে রংমহলে আবদ্ধ হতেই হবে!! 


তার কথা শুনে শরীরে শিহরণ খেলে উঠলো, কান্না থেমে হা করে তাকিয়ে আছি। 

মূহুর্তে ই হাতটা শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেল। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বারবার করছি, কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমার রুমের দরজা খুলে আমাকে ভিতরে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। 

ওপাশ থেকে বলল- আমার রংমহলে অনেক আগে থেকেই আবদ্ধ তুই, তুই চাস আর না চাস আমাতেই তোর শুরু আমাতেই শেষ। 


_______বর্তমান...


চোখ ভর্তি জল, রুম বন্ধি আমি!! বিছানায় শুয়ে আছি আর ভাবছি...

রাজনৈতিক রংমহল পরিবেশ আমার কখনো ই পছন্দ না অথচ আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী রাজনৈতিক রংমহলে আবদ্ধ। এই রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বাঁচতে আমি চার বছর আগে চতুদর্সী বয়সে বাড়ি ছেড়ে নিজের নানু বাড়ি উঠেছিলাম। সেদিন ও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু ভয়ঙ্কর!! খুব কাছের কাউকে হারিয়ে আমি চঞ্চল থেকে চুপচাপ হয়েছি, তার দায়িত্বের সমস্ত কিছু আমার কাঁধে নিয়ে আমি না চাইতেই অদৃশ্য এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি.....


হঠাৎ করেই মোবাইল এ টুং শব্দ ভেসে এলো। ফোন টা খাটের উপর থেকে নিলাম, আমার বান্ধবী নীলার ফোন থেকে মেসেজ এলো, একটা ছবি ও এলো। আমি খুলতেই চমকে উঠলাম, রক্তে ভেজা একটা চিরকুট, আরে এটা ই তো সেই চিরকুট, যাতে লিখা - 


"সময়টা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো!! তুমি খুব সুন্দর। আজ দু'বছর ধরে তোমাকে দেখছি, আর পারছি না, একপাক্ষিক ভালোবাসা সত্যি ই ভয়ঙ্কর। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব শীঘ্রই আসছি আমি আমার করে নিতে।"


ইতি তোমার চেনা জানা একজন!!


খুব চিন্তিত হয়ে গেলাম। আমার বেরঙের জীবনে এ কোন পাগলের আমদানি। যাকে আমি জানি চিনি। সারাজীবন গার্লস কলেজে পড়লাম, কে এই ব্যক্তি? অদ্ভুত তো। ভাবতে ভাবতে ই ঘুমিয়ে পড়লাম।


_______


ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙল, ফ্রেশ হলাম, নামাজ আদায় করে নিলাম, চার বছর পর বাবার আদেশে এই বাড়িতে কাল এসেছি। কিন্তু আমার মস্তিষ্কে আজ ও সে বিচরন করে‌। তার কথা, আবদার, আমাদের খুনসুটি গুলো আজ ও আমাকে টানে। বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কবরখানা দেখা যায়। বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কি সুন্দর শুয়ে আছে, অথচ কৃষ্ণচূড়া থেকে ও তার গোলাপ পছন্দ, কিন্তু আমার পছন্দের ফুল গাছ ই সে বাগান ভর্তি করে লাগিয়ে গিয়েছিল.....

একটা বড় নিঃশ্বাস নিলাম। হঠাৎ চোখ গেল, সমুদ্র ভাইয়ার দিকে, সকাল সকাল জগিং করতে বের হয়েছে, লোকটি সত্যি ই অদ্ভুত!! চতুর !! বত্রিশ বছর বয়সের এই পুরুষটি অনেক এট্রাকটিভ, হ্যান্ডসাম ও, দেখতে ছাব্বিশ_সাতাশ বয়সের যুবকের মতো লাগে। এটা সত্যি যে, আমার কিশোরী বয়সের প্রথম ক্রাশ ওনি..... মূহুর্তে ই মনে বুদ্ধি চাপলো...দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলাম....


চলবে....

#রংমহলে_আবদ্ধ_চড়ুই

সূচনা পর্ব 

#Writer_Neel_Noor 


(কেমন হয়েছে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। রিসপন্সের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পার্ট দেওয়া হবে)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই

রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই