রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই
#রংমহলে_আবদ্ধ_চড়ুই
৩
#Writer_Neel_Noor
এসে উড়া_ধুড়া নাচতেছি। এখন একটা লুঙ্গি ডান্স দিতে ইচ্ছে করতেছে। ইশ্ কতগুলো কথা শুনিয়ে এসেছি, নিজেকে শান্ত করলাম!! যেদিন মুক্তি পাব এই আবদ্ধ রংমহল থেকে সেদিন না হয় পার্টি করব, মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি...হি হি হি হু হু হু হাহা হাহা.....
হঠাৎ করেই দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি, জীবনের খুব ই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। না, দরজা বন্ধ করে নাই, বরং দরজা টা খুলে হাসি মুখে ভেতরে এসেছে। চোখ ভরা তৃপ্তির ঢেকুর!!
আমি ও খুশি হলাম!! যাকে বলে মাত্রাধিক খুশি!! দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
বললাম - আল্লাহ !! আজ কার মুখ দেখে উঠেছি, সাদিয়া আপু তুমি এখানে, এই বাড়িতে? এতো সকাল বেলা!!
সাদিয়া আপু হচ্ছে সমুদ্র ভাইয়ার বোন। আমার থেকে বয়সে সে সাড়ে চার বছরের বড়। তার বিয়ে হয়েছে, চার বছর আগেই। স্মৃতির পাতায় চার বছর আগের সেই বছরটি বড্ড ই ভয়ঙ্কর!! কালো অতীত!! কী নেই সেই বছরটিতে?
সাদিয়া আপু আমাকে মাত্রারিক্ত ভালোবাসে। আদুরে গলায় বলল - আরে থাম থাম! এতো গুলো প্রশ্ন একসাথে কেউ করে, পাগলী!! আগে বল, কেমন আছিস! সেই যে, আমার বিয়ের বছর ই বাড়ি থেকে বের হলি, আর তো দেখা সাক্ষাৎ নেই রাজকুমারীর, শুধু ফোনেই কথা বলা!! খুশি হয়েছি,তুই সেই ধাক্কা টা ভুলে এ বাড়িতে ফিরে এসেছিস।
মুখটা পানসে করে বললাম - রাখো তো সে কথা!! কখন এলে বললে না তো? দুলাভাই কি এসেছে। তোমার সোনা_মনির কি অবস্থা!! কোথায় সে, এক নজর দেখার জন্য মন ইতুপিতু করছে....
সাদিয়া - এলাম কিছুক্ষণ আগে, যখন আপনি সিঁড়ি তে দাঁড়িয়ে কথার তীরে আমার ভাইকে আঘাত করেছিলেন!! আপনি কী তাহাকে চিনেন না? জানেন না? আপনার কি তার গম্ভীরতা, পাগলামী, রাগী... এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের দিকের কথা শুনেন নাই!! কেন ঘুমন্ত সিংহ কে জীবন্ত করছেন আপনি, পিচ্চি!! জেগে উঠা, গর্জে উঠা সিংহকে সামলাতে পারবেন তো, পিচ্চি!!(মুচকি হেসে)
চোখদুটো নিভু নিভু করে বললাম - আমার সাথে একদম রসিকতা করবা না, সাদিয়া আপু!! আর সমুদ্র ভাইয়ার মতো এতো পিচ্চি পিচ্চি করো কেন?(সাদিয়া আপু মুখ চেপে হাসছে)আমি আর ছোট্ট আয়াতুল ফারিন ঝিনুক নই, আমি বড় হয়ে গেছি!! হতে পারে তোমার ভাইয়ের অনেক ফ্যান ফলোয়ার আছে, মেয়েরা এমন ই ইয়ং, হ্যান্ডসাম, পাওয়ারফুল, বুদ্ধিমান পুরুষদের জন্য পাগল, কিন্তু আমি না!! বুড়ো একটা পুরুষ, আমার সুন্দর, সুখী জীবনে টর্নেডো, সাইক্লোন এর মতো ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এসেছে!! তোমার ভাইকে আমি মানি না, তাহার কথা শুনতে ও চাই না !! আমি তার থেকে মুক্তি চাই...সরো তো এখান থেকে, আমি আলভি(সাদিয়া আপুর ছেলে) এর কাছে যাই.... দুলাভাই এর সাথে দেখা ও পরিচয় হয়ে আসি....
ঝিনুক রুম থেকে বের হয়ে গেল। সাদিয়ার মুখে একটু কালো আঁধার দেখা গেলো। দু'চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, মনে মনে বলল - চঞ্চল মেয়েটি কি সত্যিই পাল্টে গেছে? নীরব হয়ে গেছে নাকি রাগী হয়ে উঠেছে? সে যাই হোক না কেন....তোর মুক্তি নেই, এই আবদ্ধ রংমহল থেকে !! নাহ, মুক্তি নেই!!
_______
রুম থেকে দৌড়ে তো বের হয়ে গেলাম আলভি বাবাটার খোঁজে। কে জানে, সোনামনি টা কোথায় আছে। যদিও খুঁজে পাওয়া টা বেশি দুস্কর হয়ে উঠবে না। কারন, বাড়িটিতে মানুষের সংখ্যা টা কমে গেছে!! ছোট চাচার মেয়ে ও ছেলে দুজন ই শহরের বাইরে!! মুনতাহা আপু সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানে ই সে পড়াশোনা করছেন। আর নাজিম রায়হান ভাইয়া, সে একজন পুলিশ অফিসার, ভাইয়া আপাতত সিলেটেই ট্রান্সফার হয়েছে মুনতাহা আপুর জন্য। শেষ এ রইলো, ফারহান সাহিল ভাইয়া যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি। জীবনে সমুদ্র ভাইয়া কে ক্ষমা করে দিলেও, তাকে আমি কখনো ই ক্ষমা করতে পারবোনা। তার প্রতি রয়েছে আমার এক বুক ভর্তি অভিশাপ!!
যাইহোক, এই বাড়িতে সব বড়রা ই থাকে। তাই , শুধু মাত্র কয়েকটা রুম ই খোলা। বাকিগুলো বন্ধ থাকে, দুদিন পর পর কাজের লোকরা পরিষ্কার করে।
আলভির কন্ঠস্বর ভেসে আসছে, সে খুবই খুশি মনে হচ্ছে। তার হাঁসি আর অস্পষ্ট মিষ্টি ভয়েস (মাত্র ২ বছর) জানান দিচ্ছে, সে প্রান খুলে হাসছে। খুব ই আনন্দ পাচ্ছে। বাচ্চারা সচরাচর নানা বাড়িতে তাদের আনন্দের চাবিকাঠি খুঁজে পায়, আলভি ও তা পেয়েছে হয়তো!! রাইটার নীল নূর।
এগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে কাঙ্ক্ষিত রুমটার সামনে চলে এলাম বুঝতে পারি নাই। ভালো করে তাকাতেই দেখি আমি সমুদ্র ভাইয়ার রুমের দরজার সামনে। দরজাটা খোলা ই রয়েছে। সমুদ্র ভাইয়া রেডি হচ্ছে, আলভিকে কিছু বলছে, আলভি হাসতেছে, আর আলভি কিছুক্ষণ পর পর সমুদ্র ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরছে, ফাইল সহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে, সমুদ্র ভাইয়া বিভিন্ন বাহানায় আলভি থেকে সেগুলি নেওয়ার চেষ্টা করছে। সত্যিই মানুষ টি অদ্ভুত, মাঝে মাঝে আমি ও দোটানায় পড়ে যাই, তার সবকিছু ই কোন না কোন ভাবে চুম্বকের মতো আমাকে টানে!! শুধু আমি নই, তাহার কর্মকাণ্ড সতিই এতোটাই প্রশংসনীয়, যেটা ভালো থেকে মন্দ সব মানুষের মনে ধরবেই। ইবেন, এমন ও শুনেছি, সমুদ্র ভাইয়ার শত্রুরা ও তার কাজ, কর্মকান্ড, ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তায় প্রশংসা করে। যাইহোক, আমি যে এখানে দুই তিনেক মিনিট দাঁড়িয়ে আছি, সেটা ওনি খেয়াল করে নাই.....
আমি আর ভেতরে গেলাম না। পিছু পায়ে পা দিতেই, কারো সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেছি। দেখি দুলাভাই দাঁড়িয়ে আছে....
আমাকে দেখে সে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটা হাসি দিল। একে তো ধাক্কা, তার উপর বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাঁসি দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। যদি ও মুখে প্রকাশ করলাম না। নিজেকে সামলিয়ে বললাম - আসসালামুয়ালাইকুম, দুলাভাই!! কেমন আছেন?
সে সেই আগের হাসিতেই মাথা হেলিয়ে বলল- ভালো, ভালো। তুমি আয়াত না? আমার মেজো চাচা শ্বশুরের মেয়ে না?(আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা দিলাম,আজব মানুষ তো, সালামের উত্তর ও নিলো না।) সে চোখ দুটো বড় বড় করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো, দৃষ্টিটা আমার দৃষ্টিকটু লাগলো, সে বলল- মা_শা_আল্লাহ!!মা_শা_আল্লাহ!!এই মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে। সুন্দর ও তো হয়ে গেছে। তুমি তো আগেও সুন্দর ছিলা, তবে এখন দেখতে, (উপর থেকে নিচে বারবার তাকাচ্ছেন) শরীরের দিকে দিয়ে....
আমি উড়নাটা ঠিক আছে কিনা দেখলাম। এর মধ্যে ই সে এগিয়ে এসে, আমার মাথায় হাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই, আমি অপ্রস্তুত হয়ে চোখ বুজে ফেললাম।
হঠাৎ করেই কেউ আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিলো। চেনা পারফিউম এর ঘ্রান। সেই শীতল স্পর্শ, মূহুর্তের মধ্যে ই বুঝে উঠতে সক্ষম হলাম, এটা সমুদ্র ভাইয়া। চোখ গুলো খুলে উপরে দিকে তাকাতেই দেখি ওনি দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে আলভি কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আরেক হাতে তার বাহুডোরে আমাকে আবদ্ধ করে রেখেছে...
সমুদ্র ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল - আলভি কে কোলে নে!! আর রুমে যা। (আলভি কে আমার কোলে দিয়ে দিলো, আলভির সাথে ফোনে ভিডিও কলে প্রায় ই কথা বলি, তাই সোনামনি টা আমাকে দেখে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো)
দুলাভাই - আরে, শালা সাহেব!! শালিকাকে কোথায় যেতে বলছেন। সেই, বিয়ে বাড়িতে ছোট থাকতে দেখছিলাম। এখন তো, যে সুন্দরী হইছে, অপ্সরা কে ও হার মানাবে....
আরো কিছু বলার আগেই, সমুদ্র ভাইয়া আমার দিকে সেই বিখ্যাত চোখ লাল করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল - তুই যাস না কেন এখান থেকে!! যা...(একটু চিল্লিয়ে)
আমি চুপচাপ আলভি কে নিয়ে স্থান টি ত্যাগ করলাম। তারপর আর দুলাভাই এবং সমুদ্র ভাইয়ার কথোপকথন শুনতে পারলাম না....
________
অন্যদিকে সমুদ্র খুবই রেগে আছে। নিজের বোনের স্বামীর চরিত্রে যে একটু উপর নিচ আছে সে জানে। তবে আজ তার সামনেই যে এরকম করবে জানা ছিল না।
সে কখনো ই বোনকে এরকম একটা পরিবার এবং ছেলের সাথে বিয়ে দিতো না। তবে সমুদ্রের দাদা মুজিবুর শেখের সাথে রমিজ শিকদারের বন্ধুত্ব ছিল বেশ গভীর। বন্ধুত্বের গভীর মায়ায় মুজিবুর শেখ শিকদার কে কথা দিয়েছিল, এই বংশের মেয়ে তাদের বাড়ির বউ হবেই হবে, তাইতো না চাইতেও মুরুব্বিদের ওয়াদা দেওয়ার বলি হয়েছে সাদিয়া ।। বিজনেস দুনিয়ায় শিকদারদের যেমন আলাদা নাম আছে, ঠিক তেমনি নাম ও দাপট আছে রাজনৈতিক রংমহলে। তাইতো খলিল শেখ(সমুদ্রের বাবা), বিনা বাক্যে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। এসব কিছু সমুদ্র সাদিয়ার বিয়ের পরে জেনেছে, পরিবারের, বংশের সম্মান বাঁচাতে, কথা রাখতে সে চুপচাপ আছে। আর, তার চুপচাপ মেনে নেওয়ার মাশুল গুনছে সাদিয়া।
সমুদ্র নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল- ছোট বোনের জামাই আপনি, এখন ও সময় আছে, এই লেবাসটা পাল্টান। আমি সবসময় এড়িয়ে যাব না। তাছাড়া, ও আপনার শালি না, ভাবি ও লাগে। আমার বিবাহিত স্ত্রী!! যথেষ্ট দূরে থাকবেন, নিশ্চয়ই জানেন, সমুদ্রের নজর চিলের থেকে ও ভয়ঙ্কর!! শশুর বাড়ি তে এসেছেন, শশুর বাড়ির ভোজন বিলাস করেন, শুধু ই পঁচা শামুকে পা কাটবেন না...
...সমুদ্র দপাদপ মিলন শিকদার (সাদিয়ার জামাই)কে অতিক্রম করে চলে গেল। মিলন শিকদার ক্ষোভ ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল, একটা বাঁকা হাঁসি দিয়ে নিজের চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিলো.....
_______
মনে মনে সমুদ্র ভাইয়া কে আজ অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানিয়েছি। ওনি অপ্রস্তুত সময়ে আমাকে রক্ষা করেছেন। তবে ধমক না দিলে ও পারতেন। শুধু শুধু, রাগ দেখালেন...ভালো করে বল্লে কি হতো। যেন দোষ করেছি, দোষ না করলেও আমি দোষী থাকব ই সারাজীবন তার চোখে...হু (মনে মনে ই ভেঙচি কাটলাম)
সারাটা দিন ভালো ই গেল। সাদিয়া আপুর জামাই সকালেই চলে গেছে। কি যেন মিটিং আছে। সমুদ্র ভাইয়া ও আজ দুপুরে ফিরে নাই, সে ও ব্যস্ত!! বাবা চাচারাও ব্যস্ত বিজনেস নিয়ে, সন্ধ্যা হতেই এই রংমহলে যেমন পুরুষদের বিস্তার চলে, ঠিক তেমনি দিন হলেই, শেখ রংমহলে মহিলারাই রাজ করে।
.....
চলবে....
(কপি করলে অবশ্যই রাইটারের নিজস্ব নাম মানে আমার নাম দিবেন, তা না হয় আমার গল্প কপি করবেন না)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন