রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই

 


#রংমহলে_আবদ্ধ_চড়ুই

#Writer_Neel_Noor 


একটা বড় নিঃশ্বাস নিলাম। হঠাৎ চোখ গেল, সমুদ্র ভাইয়ার দিকে, সকাল সকাল জগিং করতে বের হয়েছে, লোকটি সত্যি ই অদ্ভুত!! চতুর !! বত্রিশ বছর বয়সের এই পুরুষটি অনেক এট্রাকটিভ, হ্যান্ডসাম ও, দেখতে ছাব্বিশ_সাতাশ বয়সের যুবকের মতো লাগে। এটা সত্যি যে, আমার কিশোরী বয়সের প্রথম ক্রাশ ওনি..... মূহুর্তে ই মনে বুদ্ধি চাপলো...দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলাম....


এই সকাল বেলা, মা সহ বড় চাচি, ছোট চাচি রান্না ঘরে। সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। আমাদের যৌথ পরিবার, দাদার কড়া আদেশ শেখ বাড়ির নাম ক্ষুন্ন হবে এমন কিছু সে মোটেও মেনে নিবে না, যত বাঁধা বিপত্তি আসুক, যা ই হোক না কেন সবাইকে এক হয়েই থাকতে হবে। দাদা ছিলেন বড় রাজনীতিবিদ। তার জীবনের অনেক বছর ই সে রাজনীতির রংমহলে আবদ্ধ ছিল। এই রাজনৈতিক সহিংসতা তার জীবন কেড়ে নিলেও, মরার আগেও তিনি বড় চাচাকে রাজনীতি না ছাড়ার আদেশ দিয়ে গেছেন। তাই তো সমুদ্র ভাইয়া আজ রাজধানীতে!!তাছাড়াও আমার দাদার দাদা একসময় জমিদার ছিলেন, পুরোনো অনেক নিয়মের মাঝে আমাদের পরিবারের সবাইকে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়!! যা সত্যি ই অসহনীয় লাগে আমার কাছে......


এই যে, সকাল সকাল...এতো কাজের লোক থাকতে ও কেন বাড়ির সব বউদের রান্না ঘরে ই থাকতে হবে? অদ্ভুত নিয়ম!! অথচ, কাজের লোকরা রান্না করতে পারত আর বাড়ির বউরা এই সকাল বেলা রেস্ট করত!! কিন্তু না, এই বাড়ির কড়া আদেশ,নিয়ম... রান্নাঘরে কাজের লোক যাওয়া নিষেধ, আর বাড়ির বউ মেয়েদের রান্না করতে ই হবে.....


আমি চুপচাপ রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বললাম - আমাকে খাবার দাও!! রাতে কিছু খাওয়া হয় নাই, আমার খুবই খিদে পেয়েছে!


মা- আয়াত (আয়াতুল থেকে আয়াত) !! চার বছর বাড়ি থেকে দূরে ছিলে, এই নয় যে তুমি বাড়ির নিয়ম কানুন ভুলে যাবা। বাড়ির পুরুষরা আগে খাবার খেয়ে নিক, তারপর খেতে বসবা।


বিরক্ত প্রকাশ করে, সাবলীল ভাবে ই মাকে বললাম - মা দেখো, আমার এই অদ্ভুত নিয়ম ভালো লাগে না। যদি খাবার দিতে ইচ্ছে হয় দাও, না হয় আমি বাহিরে গিয়ে রাস্তায় আসেপাশে হোটেল থেকে খেয়ে নিব। রাত থেকে পেটে ইঁদুর চুচু করতেছে......

মা আমাকে কিছু বলবে, তার আগেই ছোট চাচি খাবারের প্লেট হাত ধরিয়ে দিয়ে বলল - তুই, এরকম কেন হয়ে গেলি আয়াত!! রগচটা, গম্ভীর....


কিছু না বলেই খাবার নিয়ে চুপচাপ টেবিলে খেতে বসলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, সমুদ্র ভাইয়াকে নিয়ে মা চাচিদের সাথে কথা বলব। কিন্তু, তাদের ব্যবহার, কথাবার্তার ধরন শুনে বুঝলাম তারা আমার সাথে কখনো ই সায় দিবে না। তাই, খাবারের টেবিলে বসে আমি বাবা চাচা দের জন্য অপেক্ষা করতেছি.....


আমার দাদার তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় চাচার দুই ছেলে, এক মেয়ে!! বড় ছেলে, আব্রাহাম ফারহাদ সমুদ্র ভাইয়া, ফারহান সাহিল ভাইয়া আর সাদিয়া আপু । সমুদ্র ভাইয়া বড় সাহিল ভাইয়া মেজ আর সাদিয়া আপু ছোট (আমার থেকে তিন বছরের বড়) । আমার বাব মেজো, তার ঘরে আমি আর আমার ভাইয়া । ছোট চাচার ঘরে দুই মেয়ে নাদিয়া জামান (যে দুনিয়াতে নেই) মুনতাহা আপু আর এক ছেলে নাজিম রায়হান। ফুফুর এক ছেলে এক মেয়ে। তানিশা আপু আর তিহান ভাইয়া। অদ্ভুত হলেও সত্যি আমি এই পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য। 


ছোট থেকে ই আমি খাবার খাওয়াতে অনেক ধীরস্থির। খাবার নিয়ে বসেছি, ঘড়ির কাঁটা মিলালে আধাঘণ্টা হয়ে যাবে, এর ই মাঝে বাড়ির পুরুষরা খাবার খেতে এলো। আমাকে এখানে দেখে কেউ ই প্রতিক্রিয়া করলো না, কারন এই পরিবারে সবাই জানে আমি নিয়ম ভাঙার কারিগর। 


সমুদ্র ভাইয়া তার সাথে চলে চ্যালা পেলাদের নিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসলেন। আড়চোখে খাবার রেখে আমি তাকিয়ে আছি। ঘামাক্ত পুরুষ টিকে আমার কাছে খুবই লোভনীয় খাবারের মতো লাগছে। সবাইকে হাতের আঙুলে ইশারা দিয়ে কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। যেন, এই রংমহলের রাজা সে!! একপর্যায়ে কথা বার্তা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো, পাশে থাকা ছেলেরা সালাম জানিয়ে চলে গেল....


সোফা থেকে টাওয়াল দিয়ে শরীর টা মুছতে মুছতে খাবার টেবিলে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলো। ওনি বসতে ই আমি খাবারের প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম...দুই পা এগোতে ই মা চিল্লাতে লাগলো, বলল- এখনো খাবারের প্লেটে অর্ধেক খাবার থাকে কি করে? তোর না অনেক খিদে পেয়েছে, ঘাড় তেড়ামি করে এখন ই খাবার খেতে বসলি!!তুই না আধাঘণ্টা ধইরা খাইতেছিস!! খাবার তো প্লেটে ই রয়ে গেছে....তুই কি কখনো ই পরিবর্তন হবি না? 


বললাম- আমার খাওয়া শেষ। 

কথাটা বলেই, খাবারের প্লেটটা রান্নাঘরে রেখে এলাম। বাড়ির পুরুষরা সবাই এখানে আছে, তাই মা আড় কথা বাড়ালো না। এখন ই উত্তম সময় আমার কথাটা বলার। 


বড়চাচা, বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম - বড় চাচা, বাবা এখানে তো সবাই ই আছেন, আমার আপনাদের কিছু বলার আছে। আমি তো এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, আমি চাচ্ছিলাম আমার বাকি পড়াশোনা টা বাহিরে শেষ করতে। তাছাড়া ভাইয়া ও তো বাহিরেই পড়াশোনা করছে, আমি না হয়.....


আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সমুদ্র ভাইয়া বলল- সাহিন(আমার ভাই) এর সাথে নিজেকে তুলনা করিস না। আমি তোকে কোথায় ও যাওয়ার পারমিশন দিব না। তাছাড়াও কয়েকমাস পর সাহিন ও দেশে ফিরবে, তারপর হয়তো সাহিন এব্রোড নাও যেতে পারে। তুই যদি পড়তে চাস তাহলে দেশে থেকে ই পড়তে হবে.... ভালো করে এডমিশনের প্রিপারেশন নে, ঢাকাতেই চান্স পেতে হবে। আর যদি না পড়তে চাস, আমার আপত্তি নেই!! জমিয়ে সংসার করি চল....


গা পিত্তি জ্বলে গেলো। কি বেহায়া!! নিরলজ্জ পুরুষ কোথাকার!! সব কথায় তার নাক গলাতে ই হবে। বাড়ির সকল ডিসিশন তার কথায় ই হবে। 

নিজেকে শান্ত করে বললাম - সমুদ্র ভাইয়া!! আমার জীবনে আপনি আর নাক গলাইয়েন না, অধিকার খাটাইয়েন না!! কে আপনি? আপনাকে...


সমুদ্র ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলল- ঝিনুক!! সবসময় তোর পাগলামি মেনে নেওয়ার মতো সুপুরুষ আমি নই। আমি যা বলব, সেটাতে ই শুরু সেটাতেই শেষ। তাছাড়া আমি তোর হাসবেন্ড, তো তোর সকল কিছু...


এবার তেলে বেগুনে চেতে উঠলাম। বললাম - আপনি আমার থেকে চৌদ্দ বছরের বড় মিস্টার সমুদ্র শেখ!! আমি কেন আপনার মতো বয়স্ক পুরুষকে স্বামী হিসেবে মেনে নিব!! আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মানা দূরে থাক, আপনাকে তো আমি....


বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দিল, বলল- আয়াত!! কথা সামলিয়ে বলতে শিখো!! বড় হয়েছো এখন!! তাছাড়া তোমার মানা আর না মানায়, সত্যিটা  পাল্টিয়ে যাবে না, তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে!!


ক্ষিপ্ত চোখে সমুদ্র ভাইয়ার দিকে তাকালাম!! সে মিটিমিটি হাসছে, যেন পাহাড় সমুদ্র সৈকত জয় করে এসেছে। এই সমুদ্র ভাইয়া!! সত্যি ই আমার জীবনের টর্নেডো ঝড়!! সাইক্লোন ঝড়!! নার্গিস ঝড়!! মস্ত বড় একটা আপদ, ঘূর্ণিঝড়!!

নিজের চুল এখন নিজের ই ছিঁড়তে ইচ্ছে করতেছে, জীবনে এই ব্যাটার কারনে আমি মনে হয় ভেড়ার বা*ল ও ছিঁড়তে পারব না, তাহার পারমিশন লাগবে। দপাদপ হেঁটে সিঁড়ির দিকে গেলাম, সেখানে থেমে গেলাম, বললাম - বাবা, আমি এখন আঠারো তে পা দিয়েছি, অষ্টাদশীর ঘড়ি পূর্ণ হয়ে গেছে!! আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি!! আমি সমুদ্র ভাইয়ার সাথে কখনো সংসার করব না, যাকে ভাইয়ার চোখে দেখি তাকে নিয়ে সংসার করতে পারব না!! আমি মিস্টার সমুদ্র শেখের থেকে ও ভালো, ইয়ং কাউকে ডিজার্ব করি!!


কারো কোনো রিয়েকশন দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম না। তাড়াতাড়ি উপরে চলে গেলাম!!


________


সমুদ্র খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই, খলিল শেখ (সমুদ্রের বাবা) এর ডাক পড়লো, বলল- সমুদ্র!!  শান্ত হয়ে বসো, ঝিনুক এখনো ও ছোট, আরেকটু সময় দাও!! 


সমুদ্র - বাবা, অনেক হয়েছে!! এবার থামো। ও নিজেই তো বলল, ও নাকি বড় হয়েছে, অষ্টাদশী ঘড়ি পূর্ণ করেছে, আমার জিনিস এবার আমাকে ই না হয় বুঝে নিতে দাও!! ও সমুদ্র কে দেখেছে, তবে শান্ত ও নীরব সমুদ্র কে, সমুদ্র_সৈকত যখন উত্তেজিত হয়ে যায়, তখন ভয়াবহ দুর্বিষহ ডেকে আনে!! আজ থেকে ওর জীবনে আমি সমুদ্রের অন্য রুপের আগমন ঘটবে....আশা করবো তোমরা আমাদের মাঝে আসবে না!!(সমুদ্র যেন পরিবারের সদস্যদের মাঝে একপ্রকার নীরব থ্রেট দিয়ে গেল)


সমুদ্র আর খাবার খেলো না, চুপচাপ সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো....


_______


রুমে এসে উড়াধুড়া নাচতেছি। এখন একটা লুঙ্গি ডান্স দিতে ইচ্ছে করতেছে। ইশ্ কতগুলো কথা শুনিয়ে এসেছি, নিজেকে শান্ত করলাম!! যেদিন মুক্তি পাব এই আবন্ধ রংমহল থেকে সেদিন না হয় পার্টি করব, মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি...হি হি হি হু হু হু হাহা হাহা.....


হঠাৎ করেই দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি, জীবনের ....


চলবে....

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই

রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই

রঙমহলে আবদ্ধ চড়ুই